পরশ মির্জা’-নারী’ মানবপ্রাণী জগতে স্বাভাবিক দুই লিঙ্গের এক লিঙ্গের নাম। পৃথিবীতে যে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে দুটি লিঙ্গের মিলিত স্রোত ছাড়া অকল্পনীয়। এই মিলিত স্রোতের শক্তিই পৃথিবীতে প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করে। মানবপ্রাণীও এর বাইরে নয়। এই যে সার্বজনীন প্রাকৃতিক নিয়ম তা কি অস্বীকার করার কোন অবকাশ আছে? নিশ্চয়ই নেই।
আদিমযুগে মানুষ পরিবারবিহীন দলবদ্ধভাবে জীবনযাপন করত। যাযাবর শিকারী জীবন ছিল। বাঁচার প্রয়োজনে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য এবং খাদ্যের অন্বেষনে ছুটে বেড়াত দিক থেকে দিকে। কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাসের ভাবনা তাদের মাঝে ক্রিয়া করেনি এবং তা স্বাভাবিক কারণেই। একদিকে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অাক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্বিপাক থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা এবং খাদ্যের অন্বেষন এ দুটি কারণেই যাযাবর জীবন বেছে নেয় আদিমযুগের মানুষেরা।
কালের বিবর্তনে আদিমযুগের মানুষেরা তাদের অদম্য শক্তির বলে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার স্পৃহা অর্জন করে, অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের বশে আনার বিভিন্ন পদ্ধতি আবিস্কার করে এবং খাদ্য সংগ্রহের নিশ্চয়তা অর্জন করতে থাকে। এসবের ফলে যাযাবর জীবনের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে বসবাসের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই আগ্রহ থেকেই প্রয়োজন পড়ে পারিবারিক জীবনের। পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনেই নির্দিষ্ট নারী-পুরুষের একত্রে বসবাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নির্দিষ্ট নারী-পুরুষের একত্রে বসবাসের মেলবন্ধন থেকেই গড়ে উঠে পরিবার প্রথা।
আদিম নারী-পুরুষ যখন পরিবারবদ্ধভাবে বসবাস করতে লাগল তখন তাদের মাঝে জীবনের এক নতুন দ্বার উম্মোচিত হলো। জীবনের ইতিবাচকতার নতুন আলোর সন্ধান পায়। জীবনের নতুন আলোর সন্ধান পেয়েই পরিবারের ভিত মজবুত করতে থাকে নারী-পুরুষের যৌথ মিলিত শক্তি। নারী-পুরুষের যৌথ হাতই এগিয়ে নেয় জীবনসংসারকে। কালের স্রোতের বহমান ধারায় নারী-পুরুষের যৌথ হাত গড়ে তুলে সভ্যতা, গড়ে তুলে সমাজ। যার বিবর্তনের পথ বেয়ে বিভিন্ন যুগ পেরিয়ে আজকের সভ্য পরিবার ব্যবস্থা, সভ্য সমাজব্যবস্থা।
পরিবার ও সমাজের ক্রমবিকাশে পুরুষ যেমন অবদান রেখেছে তেমনি অবদান রেখেছে নারী। এককভাবে কেউ অবদান রাখেনি। এককভাবে অবদান রাখার ভাবনা তাদের মাঝে উদ্রেকও হয়নি। দুয়ের মিলিত শক্তিই পরিবার ও সমাজের ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে। এককভাবে অবদান রাখার ভাবনার উদ্রেক কেন হয়নি? এর একটি বাস্তব কারণও ছিল। আদিমযুগে ছিল সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। যার ফলে তাদের মাঝে লিঙ্গবৈষম্য ছিল না। লিঙ্গবৈষম্য না থাকায় একে অপরের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠেনি। হয়ে উঠেনি কর্তৃত্বপরায়ন। তাদের ভাবনায় তারা একে অপরকে সমান পরিপূরক হিসেবেই দেখত। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখত বলেই তাদের মিলিত শক্তি পরিবার ও সমাজের ভিত রচনা করতে পেরেছিল। আর তার মশাল তুলে দিতে পেরেছিল পরবর্তি যুগের হাতে। যুগ থেকে যুগে বিবর্তিত হতে হতেই আজকের পরিবার, আজকের সমাজ।
লিঙ্গবৈষম্য কখন দেখা দেয়? এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা অতীব জরুরী। মানুষের মাঝে যখন কর্তৃত্বপরায়নের অশুভশক্তি জেগে উঠতে শুরু করে, লোভ জেগে উঠতে শুরু করে তখন থেকেই আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে যায়। দৈহিক গঠনের কারণে পুরুষ কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে পড়ে। দেখে দেয় মানুষে মানুষে বৈষম্য। এই বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয় লিঙ্গবৈষম্য। পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্ব করতে শুরু করে। দৈহিক গঠনের কারণে নারী হেরে যায় পুরুষের কাছে।
যুগের আবর্তে সময় সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কারও দানা বাঁধতে শুরু করে মানুষের মনে। সে কুসংস্কারের কবলে পরে নারী। ফলে ব্যাহত হতে থাকে মানুষ হিসেবে নারীর স্বাভাবিক বিকাশ। বাঁধাগ্রস্থ হয় স্বাভাবিক গতিতে অবদান রাখার স্রোতধারা। এই ভূল ধরাও পড়তে থাকে মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে। ফলে তারা বেরিয়ে আসতেও চেষ্টা করে এই ভূল কুসংস্কার থেকে। যে জাতিতে এই ভুল যত আগে ধরা পড়েছে সে জাতিই তত আগে এগিয়ে গিয়েছে পৃথিবীতে। শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি করেছে। যে জাতিতে এই ভূল তেমনভাবে ধরা পড়েনি সে জাতি পিছিয়ে পড়েছে। পড়তে যে বাধ্য। অন্য জাতির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। কারন, জাতির একটি অংশকে কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ করে, প্রগতির ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে উন্নতি করা যায় না। এগিয়ে যাওয়া যায় না। এগিয়ে যেতে হলে কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে অাসতে হয়। কুসংস্কার থেকে বেরুতে না পারলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র নারী-পুরুষের মিলিত স্রোত মিলিত শক্তিই পারে এগিয়ে নিতে কোন জাতিকে। আদিমযুগে পরিবার ও সমাজ গঠনে নারী-পুরুষের সম্মিলিত ইতিহাসই তার সাক্ষ্য বহন করছে। অতএব, জাতি হিসেবে অামরা এগিয়ে যাব, না পিছিয়ে থাকব তা নির্ধারণ করতে হবে আমাদেরকেই। সময় এখন তা নির্ধারণ করার।
লেখক: প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গণসাংস্কৃতিক সংগঠক।