ম্যাডাম ফুলি’র ইলিশ ক্রয় এবং তরুন সাংবাদিকের নববর্ষ ভাবনা,পরশ মির্জা-—
পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় ব-দ্বীপে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণে শহরকেন্দ্রিক একটি শ্রেণী অতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ম্যাডাম ফুলিও সে শ্রেণীভূক্ত। সারাবছর মত্ত থাকেন রসময় বিজাতীয় অপসংস্কৃতিতে। বাংলা নববর্ষে খাঁটি বাঙালী না সাজলেই নয়। তাই পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ইলিশ কেনার মনস্থির করলেন। খাবেন পান্তা ভাত দিয়ে। পাঁজারো হাকিয়ে সাহেবকে নিয়ে ইলিশ কিনতে গেলেন বাজারে। বাজারে গিয়ে যথারীতি কিনলেন মস্ত বড় বড় কয়েকটি ইলিশ। আনন্দে গদগদ হয়ে ইলিশ নিয়ে মাছ বাজার থেকে বেরিয়ে পাঁজারোর কাছে এলেন। তা দেখে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত তরুন সাংবাদিক তারিফ দৌড়ে এল ম্যাডাম ফুলি’র কাছে। জিজ্ঞাসা করলো, মেম ইলিশ অনেক কিনলেন যে। কত দিয়ে কিনলেন?
ম্যাডাম ফুলি বললেন, ওমা! পুঁচকে সাংবাদিক বলে কি! টাকা কোন ম্যাটার হলো? সারাবছর রাতবিরেত গরম গরম পার্টি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কত্ত টাকা ব্যয় করি। ক’দিন পরেই পহেলা বৈশাখ। খাঁটি বাঙালী সাজবো। পান্তা-ইলিশ ভক্ষণ করবো। আহ! কি মজা! এই বলে ম্যাডাম ফুলি সাহেবকে নিয়ে দুলেদুলে পাঁজারোতে চড়ে চলে গেলেন। তারিফ পাঁজারোর পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।ব্যস্ত রাস্তায় কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম ফুলিকে বহনকারী পাঁজারো তারিফের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
দিনশেষে তারিফ অফিসে এসে নিজ ডেস্কে বসে। আজকে কিভাবে প্রতিবেদন তৈরি করবে তা ভাবছে। বারবার চোখে ভেসে উঠে ম্যাডাম ফুলি ও তার ইলিশ ক্রয়ের চিত্র। মনে জাগে প্রশ্ন। বাংলা নববর্ষে ইলিশ দিয়ে পান্তা ভক্ষণের রেওয়াজ কেন চালু হলো? নববর্ষের সাথে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণের কি সম্পর্ক? অতীতে পূর্বপ্রজন্ম কি নববর্ষের দিন পান্তা-ইলিশ খেতো? এমন অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয় তারিফের মনে। অস্থির হয়ে উঠে মন। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন আর তৈরি হয় না। মনে জাগা প্রশ্ন ও অস্থিরতা নিয়ে অফিস ত্যাগ করে তারিফ।
পত্রিকা অফিস থেকে সোজা রুমে চলে আসে। রাতের খাবার আর খাওয়া হয় না। তারিফের মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে নববর্ষে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণের জন্য ম্যাডাম ফুলির ইলিশ ক্রয়ের চিত্র। বিছানায় হেলিয়ে দেয় দেহ। সারাদিনের পরিশ্রমে দেহ ক্লান্ত হলেও ঘুম আসে না। শুধু ভাবছে আর ভাবছে। দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে তার আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকেই। বিষয়ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও তাই দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য ইতিহাস জানার চেষ্টা থাকে সবসময়ই। কোথাও এমন তত্ত্ব পায়নি যে, আবহমান গ্রামবাংলার মানুষ অতীতে সার্বজনিন উৎসব বাংলা নববর্ষের দিনে পান্তা-ইলিশ খেত। তাহলে কেন শহুরে একটি শ্রেণী অতি উৎসাহী হয়ে এ প্রথাটি চালু করেছে? এর সাথে বাঙ্গালী সংস্কৃতির কি সম্পর্ক? এটা ভাঁড়ামী নয় কি?
নববর্ষে সংস্কৃতির নামে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণের অপসংস্কৃতির চিত্র তারিফকে বিষন্ন করে তুলে। মনে পড়ে মাকে। মা গ্রামে থাকেন। এ মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তুু রাত যে অনেক হয়েছে। মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। মোবাইলে কল দিবে কি! ভাবে তারিফ। মানে না মন! মাকে মুঠোফোনে কল দেয়। রিং এর শব্দ শুনে জেগে উঠেন মা। দেখেন ছেলে কল দিয়েছে। এত রাতে ছেলের কল দেখে ঘাবড়িয়ে যান। চিন্তিত মনে কল ধরে জিজ্ঞাসা করেন ছেলেকে, তোর কি কিছু হইছে! তারিফ বলে, না মা। তোমাকে মনে পড়লো তাই কল দিলাম। আচ্ছা মা বলতো, তুমি কি ছোটবেলায় বাংলা নববর্ষের দিন কখনো পান্তা-ইলিশ খেয়েছ বা কাউকে খেতে দেখেছ? হঠাৎ এই প্রশ্ন করছস ক্যান? তারিফ বলে, না মা এমনি। জানতে ইচ্ছে করলো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। মা বলেন, না কুনু নববর্ষে খাই নাই। কাউরে খাইতেও দেহি নাই। বাজান, তুই কি নববর্ষে ছুটি পাইবি? বাড়ীতে আইবি? তারিফ বলে, মা আমি আসব। অবশ্যই আসব। আমাকে আসতে হবেই।
মোবাইলে মা’র সাথে কথা শেষ করে তারিফ মনে মনে বলে, নববর্ষের দিনে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণের অপসংস্কৃতি চালু করেছে ম্যাডাম ফুলি গোত্রের একটি অতি উৎসাহী মেকি শ্রেণী। এরা সারাবছর মত্ত থাকে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি নিয়ে। আর নববর্ষের দিনে মত্ত হয় পান্তা-ইলিশ ভক্ষণ করে অতি বাঙালী সাজার। এরাই চালু করেছে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণের অপসংস্কৃতিটি। ধিক! ম্যাডাম ফুলি গোত্রীয়দের! রাত অনেক হয়। ঘুমিয়ে পড়ে তারিফ।
পরের দিন অফিসে গিয়ে তারিফ বার্তা সম্পাদকের কাছে ছুটির আর্জি পেশ করে। বার্তা সম্পাদক সম্মতি দিয়েছেন। চৈত্রসংক্রান্তির দিনেই তারিফ চলে যাবে গ্রামে মায়ের কাছে।থাকবে না এই শহরে নববর্ষের দিনে। দেখবে না পান্তা-ইলিশ ভক্ষণের নষ্টচিত্র। গ্রামের মেটো কোলাহলে পালন করবে বাংলা নববর্ষ। যাবে গ্রাম্যমেলায়। শুনবে মেটোসুর!
লেখক পরিচিতি: পরশ মির্জা,প্রাবন্ধিক ও গণসাংস্কৃতিক সংগঠক